যশোর সদরের পাঁচবাড়িয়া ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা কোটিপতি নায়েব গাজী আতিয়ার রহমানের সীমাহীন দুনীতিতে অতিষ্ঠ ইউনিয়নবাসী। তার বিরুদ্ধে ঘুষ, দূর্নীতি এবং জনহয়রানীর অভিযোগের অন্ত নেই।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, টাকা ছাড়া এই অফিসে কোন ফাইলেই সহি হয়না। অনেকেই বলছেন টাকা দিলেও গাজী আতিয়ারের চাহিদা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত গ্রাহকদের ঘুরতে হয় দিনের পর দিন । জমির নামপত্তন, হাল নাগাদ, খাজনা দাখিলা কর্তন, মিউটেশনে ভুল ভ্রান্তির সংশোধন,ভিপি সম্পত্তি, দেওয়ানী মামলার তদন্ত প্রতিবেদন, ১৪৪ ধারার পিটিশন মামলার তদন্ত প্রতিবেদন, এলএসডি মামলাসহ হরেক রকম কাজের সাথে সম্পৃত্ত থাকতে হয় ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তাকে। কিন্তু গাজী আতিয়ার আইন আদালতের তোয়াক্কা না করে সব কাজেই অর্থ বানিজ্য করেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
সম্প্রতি সহকারী তহশীলদার গাজী আতিয়ার রহমানের বিরুদ্ধে এরকম কয়েকটি অভিযোগ জমা পড়েছে যশোরের জেলা প্রশাসকের দপ্তরে। যার অনুলিপি দেওয়া হয়েছে ভুমি সচিব ও বিভাগীয় কমিশনারের কাছে। এসব অভিযোগকারীরা অবিলম্বে এই দুর্নীতিবাজ ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তাকে দ্রুত অন্যত্র বদলী ও দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
সদরের পাঁচবাড়িয়া ভূমি অফিসের নায়েব গাজী আতিয়ার রহমান আপাতমস্তক একজন দূর্নীতিবাজ। টাকা ছাড়া তিনিই কিছুই বোঝেন না। আর তার এই কাজের প্রধান হাতিয়ার অফিস সহায়ক জামাত আলী। তিনি অফিসে আগত লোকদের ভুল ভাল বুঝিয়ে একটা পরিবেশ তৈরী করে স্যারের কাছে নিয়ে যান । তারপর স্যার যা করার তাই করেন।
সম্প্রতি সদরের ডাকাতিয়া গ্রামের শরীফ নামের জনৈক ব্যক্তি পাঁচ বাড়িয়া ভূমি অফিসে যান তুলানুরপুর মৌজায় তার পৈত্রিক সম্পত্তি ৮৬৮ হাল দাগের ৯ শতক জমির খাজনা পরিশোধ করতে। কিন্তু গাজী আতিয়ার তাকে নানা ভাবে হয়রানী করে ঘুরাতে থাকে। একপর্যায়ে নানা রকম আইন কানুন দেখিয়ে তার কাছে ৩ হাজার টাকার ঘুষ দাবি করেন গাজী আতিয়ার। ওই ব্যক্তি টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে । এ সময় গাজী আতিয়ার তার অফিস সহায়ক জামাত আলীকে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে বলেন। জামাত আলী তাকে নানা ভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে ২ হাজার টাকা দিতে রাজি করান। এক পর্যায়ে বিষয়টি জরুরী বিধায় তিনি ২ হাজার টাকা দিয়েই ওই ৯ শতক জমির খাজনা পরিশোধের দাখিলা কাটতে বলেন। ২ দিন পর গাজী আতিয়ার জামাত আলীর মাধ্যমে তার কাছে ৭০ টাকার খাজনা পরিশোধের একটি দাখিলা পাঠিয়ে দেন। যার নম্বর বি-১৪৫৫০১। এই ঘটনার প্রতিবাদ করলে গাজী আতিয়ার তার সাথে চরম দুব্যবহার করেন।
এখানেই শেষ নয় গত কয়েক মাসে নওয়াপাড়া ইউনিয়নের কিসমত নওয়াপাড়া, বাহাদুরপুর, পাঁচবাড়িয়া, বিরামপুর, নওদাগা, বালিয়াডাঙ্গা, শেখ হাটি ও ছোট শেখ হাটি গ্রামের অন্তত ৫০ জন লোক এই প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগ করেন যে, নওয়াপাড়া ইউনিয়নের পাঁচ বাড়িয়া ভূমি অফিসের সহকারী নায়েব গাজী আতিয়ার রহমান তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে খাজনা পরিশোধ বাবদ শত শত হাজার হাজার টাকা গ্রহণ করলেও তা সরকারী কোষাগারে জমা না দিয়ে গড় পড়তা ৮০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২৫০ টাকার খাজনার রশিদ বা দাখিলা কেটে দিয়েছেন। অথচ প্রতিটি দাখিলার বিপরীতে তিনি ১ হাজার টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করেছেন।
সম্প্রতি ছোট শেখহাটি এলাকার একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তিনি তার কবলা দলিল মুলে খরিদ করা ১০ শতক জমির নামপত্তন করাতে পাঁচ বাড়িয়া ভূমি অফিসে যান। নায়েব আতিয়ার রহমান তাকে নানা রকম ভুলভাল বুঝিয়ে ৭ হাজার টাকা দাবি করেন। পরে ৬ হাজার টাকায় বিষয়টি রফা হয়। কিন্তু ৩ মাসেও তিনি ওই জমির নামজারির পর্চা না পাওয়ায় এক পর্যায়ে বিষয়টি যশোর সদর এসিল্যান্ডকে অবহিত করলে গাজী আতিয়ার বেজায় ক্ষুব্ধ হন। তিনি ওই ব্যবসায়ীকে হুমকি দিয়ে বলেন, “ কিভাবে আপনি জমির নামজারির পর্চা পান তা আমি দেখে নেব।” ঘটনাটি এসি ল্যান্ডের নজরে আনা হলে তিনি গাজী আতিয়ারকে ডেকে ভর্সনা করেন এবং ২৪ ঘন্টার মধ্যে ওই নামজারির কেস সম্পন্ন করে গ্রাহককে খাজনার রশীদ পরিশোধ করার নির্দেশ দেন।
তালবাড়িয়া গ্রামের মোবারক আলী অভিযোগ করেন তার পিতা তাদের দুই ভাইয়ের নামে তালবাড়িয়া মৌজার ৬৫ শতক জমি হেবা দলিলের মাধ্যমে দানপত্র করে দেন কয়েক বছর আগে। গত নভেম্বর মাসে তারা দুই ভাই ওই জমি নিজেদের নামে নামপত্তন করিয়ে নিতে পাঁচবাড়িয়া ভূমি অফিসে যান। কিন্তু নায়েব গাজী আতিয়ার রহমান তাদের কাছে মোটা অংকের ঘুষ দাবি করেন। ওই পরিমান টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে জামাত আলী গাজী আতিয়ারের নির্দেশে তাদেরকে ওই অফিস থেকে এক প্রকার জোর করেই বের করে দেন। বিষয়টি জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম মিলনকে অবহিত করলে তিনি মোবাইল ফোনে গাজী আতিয়ারকে গালিগালাজ করে দ্রুত কাজটি করে দেওয়ার নির্দেশ দেন। তারপরও ওই কাজের বিনিময়ে আতিয়ারকে ৩ হাজার ৫শ’ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে।
ছোট বালিয়াডাঙ্গার কৃষক হেকমত আলী জানান, তার ৫ শতক ভিটের জমি ছাড়া কোন মাঠান জমি নেই। ওই ভিটের জমির খাজনা দিতে গিয়েও নায়েব আতিয়ারকে ৫শ’ টাকার ঘুষ দিতে হয়েছে। মধুগ্রামের ইজ্জত আলী ও নিয়ামত আলী ২ ভাই অভিযোগ করেন পাঁচ বাড়িয়ার নায়েব টাকা ছাড়া কোন কাগজে সই করেন না। প্রতিদিন ওই অফিসে যারা যে কাজের জন্যই যান না কেন তাদেরকে নায়েব সাহেবকে খুশি না করে কোন কাজ করিয়ে নেওয়ার নজির নেই।
কাজী পাড়ার রওশন আরা বেগম বলেন, তার স্বামী জীবিত অবস্থায় পাঁচ বেড়ের মাঠে ১৫ শতক জমি কিনে ছিলেন। কিন্তু জীবিত অবস্থায় তিনি ওই জমির নাম পত্তন করিয়ে যেতে পারেননি। ওয়ারেশ কায়েম সার্টিফিকেট দিয়ে তিনি নিজ নামে ও ২ সন্তানের নামে ওই জমির নামপত্তন করাতে গত সেপ্টেমর মাসে নায়েব অফিসে যান। কিন্তু নায়েব সাহেব নানান ছলচাতুরি করে তাকে ঘুরাতে থাকে। এক পর্যায়ে অফিসের স্টাফ জামাত আলী মোবাইল ফোনে তাকে ১০ হাজার টাকা দিলে ওই জমির নামপত্তন হবে বলে জানান। প্রায় ২ মাস পরে রওশন আরা বেগম ফের নায়েব অফিসে গেলে গাজী আতিয়ার তাকে কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত করে মোবাইল নাম্বার চায় ও তার কাছে ৬ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করে। এক পর্যায়ে অগত্য ৪ হাজার টাকা দিয়ে তিনি ওই জমির নামপত্তন করিয়ে নেন। শুধু তাই নয় যতদিন নামপত্তনের পর্চা হাতে পাননি ততো দিন রাতে বেলাতে গাজী আতিয়ার তাকে মোবাইল ফোনে নানা ভাবে উত্যক্ত করতো বলে তিনি অভিযোগ করেন। বিষয়টি তিনি স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধিকে জানালে গাজী আতিয়ার ক্ষ্যান্ত হয়।
এদিকে যশোর জর্জ কোর্টের আইনজীবী শেখ তাজ হোসেন তাজু তার মোয়াক্কেল ছোট শেখ হাটি গ্রামের মৃত আনছার আলী ম্যোল্যার ছেলে আবুল কালাম আজাদের পক্ষে যশোর সদর ভূমি অফিসের সাবেক এসিল্যান্ড জাকির হোসেন ও পাঁচ বাড়িয়া ভূমি অফিসের সহকারী ( নায়েব) কর্মকর্তা গাজী আতিয়ারকে বিবাদী করে লিগ্যাল নোটিশ প্রেরণ করে। যশোরের বিজ্ঞ অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের পিটিশন মামলা নং- ৯৪৯/২০ এর স্মারক নম্বর ২০২৩, তারিখ ৭.১২.২০২০ , ধারা ১৪৪/১৪৫ ফৌজদারি কার্যবিধি । ওই লিগ্যাল নোটিশের বাদী দাবি করেন, “বিজ্ঞ অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালত গত ৭.১২.২০২০ ইং তারিখে ২০২৩ নম্বর ফৌজদারি পিটিশন মামলাটির তদন্ত ভার যশোর সদর এসিল্যান্ড মহোদয়ের উপর ন্যস্ত করেন। এসিল্যান্ড জাকির হোসেন ওই মামলাটি পাঁচ বাড়িয়া ভূমি অফিসের সহকারী নায়েব গাজী আতিয়ার রহমানের উপর ন্যস্ত করেন। গাজী আতিয়ার রহমান ওই পিটিশন মামলার বাদীপক্ষ কর্তৃক মোটা অংকের অর্থে প্রভাবিত হয়ে আমার মক্কেলকে আর্থিক ভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্থ করেছেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, গাজী আতিয়ার ওই মামলার তদন্তকালে আমার মক্কেলের কাছে মোটা অংকের টাকার ঘুষ দাবি করেছিলেন। কিন্তু আমার মক্কেল ওই বিপুল পরিমানের অর্থ দিতে অস্বীকার করলে গাজী আতিয়ার ক্ষমতার অপব্যবহার করে একটা মনগড়া রিপোর্ট বাদীর অনুকুলে প্রদান করে। যাহা ১৯৪৭ সালের দূর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা তৎসহ দঃবিঃ ১৫৩(ক)/১৬৬/১৬৭/১৯৩ ধারার অপরাধ করেছেন। যার ফলে আমার মক্কেল আর্থিক ভাবে ও সামাজিক ভাবে মারাত্নক ক্ষতির শিকার হয়েছেন। ফলে আমি মক্কেলের পক্ষে ওই পিটিশন মামলার পুন:তদন্ত দাবি করছি।”
শুধু এ্যাডভোকেট শেখ তাজ হোসেন তাজু নয়, এরকম আরো বহু আইনজীবী অভিযোগ করেছেন গাজী আতিয়ার ধরাকে সরাজ্ঞান করেছেন। তিনি টাকার জন্য যা খুশি তাই করতে পারেন। এই ঘুষ বানিজ্য করেই তিনি শহরের পোষ্ট অফিস পাড়ায় কোটি টাকা খরচ করে একটি আটতলা ভবনে ১৫শ’ স্কয়ার ফুটের ২টি ফ্লাট ক্রয় করেছেন। একজন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী হয়ে তিনি প্রায় ৫০ লাখ টাকা মুল্যের নতুন মডেলের একটি নোহা মাইক্রো গাড়ি ক্রয় করেছেন। কর্মকর্তাদের চক্ষুর আড়ালে তিনি নিজে ওই গাড়ি ব্যবহার করেন এবং রেন্ট টেকারে ভাড়া খাটান। এছাড়া নামে বেনামে তিনি বহু সহায় সম্পত্তি করেছেন। এছাড়া তার নামে এবং স্ত্রীসহ পরিজনের নামে কোটি কোটি টাকার ফিকসড ডিপোজিট এবং পোষ্ট অফিসে সঞ্চয়পত্র কেনা আছে বলে একাধিক নির্ভরশীল সূত্রে জানা গেছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে গজী আতিয়ার বলেন, “অভিযোগ করা লোকের কোন অভাব নেই। আমি কি বলবো বলেন। কাজ করে দিলেও অভিযোগ না করে দিলেও অভিযোগ। আমাদের তো উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে চলতে হয়। এছাড়া অফিসের লোকজনকেও ম্যানেজ করতে হয় বোঝেন তো কিভাবে আমরা ম্যানেজ করি। যদি আমরা আয় না করি তাহলে ম্যানেজ করবো কি করে। উপরের স্যারেরা সব জানেন। আপনি একটু আমার সাথে দেখা করেন। এসব লিখে কি করবেন। একবার আসুন চা খেয়ে যাবেন।”
এই বিষয়ে যশোর সদর এসিল্যান্ড মিকাইল হোসেনের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, আমি এই অফিসে যোগদানের পর থেকে দূর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছি। ইতিমধ্যে আমার অফিসকে দূর্নীতিমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছি। আমার অনেক তহশীলদারও ইতিমধ্যে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন। মানুষের কাছে নিজেদের সেবার মান বৃদ্ধি করতে পেরেছেন। কেবলমাত্র পাঁচবাড়িয়া ভুমি অফিসের তহশীলদার গাজী আতিয়ারসহ ২/১ জনকে এখনো বদলাতে পারিনি। চেষ্টা করে যাচ্ছি।
এসিল্যান্ড বলেন, তিনি বর্তমানে ১৫ দিনের সরকারী প্রশিক্ষণে অফিসের বাইরে আছেন। অফিসে যোগদান করেই এই বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে তিনি এই প্রতিবেদককে আশ্বস্ত করেন।
সুত্রঃ স্বাধীন কণ্ঠ
No comments:
Post a Comment