যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে আলোচিত তিন বন্দি খুনসহ আরো ১৫ জন আহতের ঘটনার মামলায় ১২ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কর্মকর্তাসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট এবং বাকি ৪ কিশোরের বিরুদ্ধে দোষীপত্র দেয়া হয়েছে। তবে ঘটনার সাথে জড়িত থাকার প্রমাণ না পাওয়ায় একজন প্রশিক্ষককে এই মামলা থেকে অব্যাহতির আবেদন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক রোকিবুজ্জামান। তবে নূর ইসলাম নামে যে হেড গার্ডকে কেন্দ্র করে ওই মারামারির সূত্রপাত তার বিরুদ্ধে তদন্তে অভিযোগ প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, গত বছর ৩ আগস্ট দুপুরে যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের হেড গার্ড নূর ইসলামের চুল কাটার জন্য মোস্তফা কামাল হৃদয় ও পারভেজকে ডেকে আনার জন্য ছোট হৃদয় নামে আরেক কিশোরকে বলা হয়। তাদের দুইজন বেডে শুয়ে থাকার সময় সেখানে গিয়ে ছোট হৃদয় চুল কাটার জন্য বলে। কিন্তু এসময় পাভেল অসুস্থতার কথা বলে চুল কাটতে পারবেনা বলে জানিয়ে দেয়। এতে মনক্ষুন্ন হন হেড গার্ড নূর ইসলাম। মোস্তফা কামাল হৃদয় ও পাভেল নেশা করে বেডে শুয়ে আছে বলে নূর ইসলাম প্রতিষ্ঠানটির সহকারী পরিচালকের কাছে অভিযোগ দেন। আর এই অভিযোগ দেয়ার সময় আহত ১৫ জনের মধ্যে একজনে শুনে ফেলে মোস্তফা কামাল ও পাভেলকে জানায়। এতে রাগান্বিত হয়ে ওইদিন বিকেল ৫টার দিকে মোস্তফা কামাল ও পাভেলসহ কয়েকজন কিশোর মিলে হেড গার্ড নূর ইসলামকে পিটিয়ে হাত ভেঙ্গে দেয়। পাশাপাশি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের বন্দি কিশোররা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। খবর পেয়ে যশোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আবুল লাইচ ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আতিকুর রহমান এবং কেন্দ্রর উপ-পরিচালক অসিত কুমার সেখানে গিয়ে কিশোরদের শান্ত করেন। পাশাপাশি কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশের পরিদর্শক শেখ তাসমিম আলম শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের আইনের আশ্রয় গ্রহণ করার পরামর্শ দেন। এই পরিবেশের মধ্যে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে আলোচনা শেষে নূর ইসলামকে মারপিট করা কিশোরদের শাসন করার কথা বলেন এডি আব্দুল্লাহ আল মাসুদ। ওইদিনই শরীর চর্চা শিক্ষক এম শাহানুর আলম তার অনুগত মোহাম্মদ আলী, খালিদুর রহমান তুহিন, ইমরান হোসেন, হুমাইদ হোসেন, রিফাত হোসেন, আনিসুজ্জামান, পলাশ ও মনোয়ারসহ কয়েকজন কিশোরকে ডেকে আনেন। এরপর ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার ফুটেজ দেখে নিহত ও আহতদের বাছাই করে এডি আব্দুল্লাল আল মাসুদের কক্ষে আনা হয়। এসময় এডি আরমান খলিফা নামে এক বন্দি কিশোরকে চড়থাপ্পড় ও লাথি মারেন। ওসখান থেকে বের করে শরীর চর্চা শিক্ষক এম শাহানুর আলম তাদের স্টোর রুমের পাশে জানালার গ্রিলের মধ্যে হাত ঢুকায়ে বাইরে থেকে ধরে রাখে এবং মারপিট করা হয়।
এভাবে মারপিটে পারভেজ হাসান রাব্বি, নাইম হোসেন ও রাসেল সুজন মারা যায়। আর ছোট হৃদয়, আব্দুল্লাহ আল মাহিম, পলাশ, সাব্বির হোসেন, সাব্বির পরামানিক, নাঈম খান, মারুফ ওরফে ঈশান, পাভেল, জাবেদ হোসেন, আরমান খলিফা, লিমন, মোস্তফা কামাল হৃদয়, সাকিব আলী ও রূপক আহত হয়। এই ঘটনায় নিহত পারভেজ হাসান রাব্বির পিতা রোকা মিয়া বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্মকর্তা কর্মচারীদের আসামি দিয়ে কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা করেন। পুলিশ এই মামলায় প্রথমেই সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, সহকারী তত্ত্বাবধায়ক (প্রবেশন) অফিসার মাসুম বিল্লাহ, এম শাহানুর আলম, মুশফিকুর রহমান ও ওমর ফারুককে আটক করে।
এরপর বন্দি কিশোর মোহাম্মদ আলী, খালিদুর রহমান তুহিন ওরফে খালেকুর রহমান, ইমরান হোসেন, হুমাইদ হোসেন, রিফাত আহম্মেদ, মনোয়ার হোসেন, পলাশ ওরফে শিমুল পলাশ ও আনিসুজ্জামানকে আটক করা হয়। এর মধ্যে অনেককে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। সূত্র মতে, হেড গার্ড নূর ইসলামের সাথে বন্দি কিশোরদের বিরোধকে কেন্দ্র করেই শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে মারপিটের ঘটনা ঘটেছে। তবে ৩ আগস্ট বিকেলে কিশোরদের মারপিটে নূর ইসলাম আহত হয়ে চিকিৎসাধীন থাকার কারণে ১৩ আগস্টের ঘটনার দিন তিনি ছিলেননা। ফলে ১৩ আগস্টের এই ঘটনার মামলায় তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। এছাড়া এই ঘটনার মামলায় আটক ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ তদন্তে পাওয়া যায়নি।
তদন্ত কর্মকর্তা চাঁচড়া ফাঁড়ি পুলিশের পরিদর্শক রোকিবুজ্জামান বলেছেন, এই মামলা তদন্ত কাজ শেষ হয়েছে। তদন্তে সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, প্রবেশন অফিসার মাসুম বিল্লাহ, শিক্ষক এম শাহানুর আলম ও মুশফিকুর রহমান এবং ৮ বন্দি কিশোর মোহাম্মদ আলী, খালিদুর রহমান, ইমরান হোমেন ও হুমাইদ হোসেনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। তবে রিফাত রহমান, মনোয়ার হোসেন, পলাশ ও আনিসুজ্জামানের বিরুদ্ধে দোষীপত্র দেয়া হয়েছে।
No comments:
Post a Comment