যশোরাঞ্চলের গণমানুষের প্রাণের দাবির মুখে ২শ’৭২ কোটি টাকার প্রকল্প করে ভৈরব খনন শুরু হয়ে এখন শেষে পথে! পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। বাকি শুধু মাত্র ২০ শতাংশ কাজ।আর নদী সংস্কার আন্দোলন কমিটি বলছে, কোনো ঠিকাদারের কাজ ডিজাইন মোতাবেক হয়নি। খনন অংশের সর্বত্রই ব্যাপক ঘাপলাবাজির মধ্যে হয়েছে। এখনও শুভংকরের ফাঁকি চলছে। আরা নানা তালবাহানায় যশোর শহরের অংশ দৃশ্যমানও হয়নি।
যদিও পাউবো নির্বাহী প্রকৌশলীর দাবি, স্বচ্ছতার সাথে কাজ এগুচ্ছে। চলতি মাস থেকেই আবার চূড়ান্ত খনন শুরু। কিছু স্থাপনা কাজে বিঘ্ন ঘটাতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট ‘জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন’ প্রকল্পের আওতায় যশোরের ভৈরব নদ পুণখনন প্রকল্পটি একনেকের সভায় পাস হয়। এই প্রকল্পে ২৭২ কোটি ৮১ লাখ টাকা অনুমোদন দেয়া হয়। ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরে নদী খননের কাজ শুরুর টার্গেট হাতে নেয়া হয়। খনন কাজ ১ জুলাই ২০১৭ থেকে শুরু হয়ে আগামী ২০২১ সালের মধ্যে শেষ করার টার্গেট গৃহিত হয়। তবে ঠিকাদারী জটিলতা কাটিয়ে ভৈরবের দু’পাড়ের ১শ’১৮টি কাঁচা পাকা অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে ২০১৮ সালের মে মাসে যশোরের শহরতলীর কনেজপুরে প্রথম কোদাল ফেলে খনন শুরু হয়।
৯৬ কিলোমিটার নদ খননের জন্য ১৫ টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ৩৮টি লটে বৃহত্তর পরিসরের এ নদ খননের কাজ পায়। যশোর মুজিব সড়কে অবস্থিত এসটি ইন্টারন্যাশনাল নামের প্রতিষ্ঠানটি পায় দু’টি লটের কাজ। একটি ভবন মেরামত ও রক্ষনাবেক্ষণ, অন্যটি পায় দু’কিলোমিটার নদ পুনঃ খনন। ঢাকার মতিঝিলের সেনাকল্যাণ ভবনে অবস্থিত ডলি কন্সট্রাকশন লিমিটেডের এসএ-এস আই জেভী নামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ৩ টি লটে পায় ৭ কিলোমিটার পুনঃ নদ খনন কাজ। যশোর পুরাতন কসবা মিশন পাড়া এলাকার নুর হোসেন নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ৪টি লটে ১২ কিলোমিটার পুনঃ নদ খননের কাজ পায়। একই এলাকার এস এ-এমএসএ-এনএইচ (জেভী) নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ১টি লটে ৪ কিলোমিটার পুনঃ নদ খননের কাজ পায়। মিশন পাড়া এলাকার এনএইচ-এমএসসি-এস এ ইউ (জেভী) নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ৮টি লটে ২৮ কিলোমিটার খননের কাজ পায়। যশোর পুরাতন কসবা মিশন পাড়া এলাকার টেকনিপ কর্পোরেশন নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ১টি লটে পায় ৩ কিলোমিটার খননের কাজ। যশোর পুরাতন কসবা মিশনপাড়া এলাকার কপোতাক্ষী এন্টারপ্রাইজ নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ৪টি লটে পায় ১১ কিলোমিটার খনন কাজ। পুরাতনকসবা বিবি রোড এলাকার রেজা এন্ট্রারপ্রাইজ নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ১টি লটে পায় ৩ কিলোমিটার কাজ। এসএস এবং এম টি (জেভী) নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ২টি লটে পায় ৫ কিলোমিটার কাজ। যশোর পুরাতনকসবা ১৯২ কাজীপাড়া এলাকার শামীম চাকলাদার নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ৩টি লটে ৯ কিলোমিটার খননের কাজ পায়। যশোর পুরাতন কসবা মিশন পাড়া এলাকার এম টি এন্ড এস এস কনসোর্টিয়াম নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ২টি লটে পায় ৬ কিলোমিটার পুনঃনদ কাজ। সাতক্ষীরার ইটাগাছা এলাকার শেখ আশরাফ উদ্দিন নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ১টি লটে পায় ২ কিলোমিটার কাজ। খুলনা ক্রস রোড-২, ৩৭ দক্ষিণ টুটপাড়া এলাকার শামীম আহসান নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ৩টি লটে পায় ৭ কিলোমিটার খনন কাজ। খুলনা ১৮ গগন বাবু রোড (২য় লেন) এলাকার আমিন এন্ড কোং নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ৩টি লটে পায় ১০ কিলোমিটার কাজ পায়। চুয়াডাঙ্গার জীবন নগরের জাকাউল্লাহ এন্ড ব্রাদার্স নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ১টি লটে পায় ৩ কিলোমিটার পুনঃ নদ খননের কাজ।
সূত্র জানায়, ৯৬ কিলোমিটারের মধ্যে যশোর শহরের ৪ কিলোমিটারসহ ১০ কিলোমিটারের কাজ দৃশ্যত হয়নি। শহরতলীর ডাকাতিয়া বোলপুর বাহাদুরপুর কনেজপুর ও চৌগাছার তাহেরপুর অংশ ও ঝুমঝুমপুর নীলগঞ্জ থেকে শুরু হয়ে রাজারহাট রুপদিয়া বসুন্দিয়া ঘোড়াগাছি পর্যন্ত ইতিমধ্যে খনন কাজ শেষ হয়েছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড দাবি করেছে। তবে ওই সব অংশে কাজ ডিজাইন অনুযায়ী দৃশ্যমান হয়নি। গত বর্ষায় অনেক অংশের কাজ শুধু ড্রেজার মেশিন নির্ভর হওয়ায় পানির নিচে অদৃশ্য ওই খনন শুধু মাপজোকের ব্যাসিসে বুঝে নেয়া হয়েছে। নদের পাড় কোনো অংশেই দৃশ্যমান না হলেও বিশাল অংকের টাকা তুলে দেয়া হয়েছে ঠিকাদারদের হাতে।
ভৈরব নদ সংস্কার আন্দোলন কমিটির নেতৃবৃন্দের দাবি, এ অঞ্চলের জনগণের দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল ভৈরব নদ খনন প্রকল্প। যশোরের মানুষের স্বপ্ন, নদটি সংস্কার হলে নদের যৌবন ফিরে পাবে। নদটিতে আবরো নৌকা চলবে। কিন্তু সঠিকভাবে কাজ না হওয়ায় নদে নৌকা চলা তো দুরের কথা, সঠিকভাবে পানির প্রবাহও চলবে না। পাউবোর প্রত্যক্ষ পরোক্ষ মদদে কয়েকটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নামমাত্র নদ খনন করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তারা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কাছে জোর দাবি করেছেন, খনন কাজটি যথাযথ তদারকি করে কাজ বুঝে নিতে হবে। সিডিউল ব্যত্যয় ঘটলে বিল আটকে দেয়াসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি ওই কমিটির।
এ ব্যাপারে ভৈরব নদ সংস্কার আন্দোলন কমিটির উপদেষ্টা ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির মার্কস বাদীর সাধারণ সম্পাদক পলিট ব্যুরোর সদস্য ইকবাল কবির জাহিদ জানিয়েছেন, ভৈরব নদের অববাহিকার মানুষের কৃষি, মৎস্য, যোগাযোগ ও পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে নদটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ অঞ্চলের মানুষের স্বপ্নকে সম্মান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী ২৭২ কোটি ৮১ লাখ টাকার বড় প্রকল্পের মাধ্যমে কর্মযজ্ঞ তুলে দেন পাউবোর হাতে। অথচ এখনে শুধু নয় ছয় হচ্ছে। গত ২৫ ও ২৬ মার্চ নদ সংস্কার আন্দোলন কমিটির পক্ষে নেতৃবৃন্দ খনন হয়ে যাওয়া নদের বিভিন্ন অংশে সরেজমিনে যান। কেনো অংশেই কাজ দৃশ্যত নয়। আর ঘাপলা ও ফাঁকিবাজির শেষ হয়েছে। কিছু কিছু খনন হওয়া জায়গায় ভরাট দেখাচ্ছে। ইতোমধ্যে কাজের প্রায় ৮০ শতাংশ শেষও হয়েছে বলে পাউবো যে বাহবা কুড়াচ্ছে তা খাতা কলমে হতে পারে, বাস্তবে নয়। তিনি ঘাপলাবাজির ওই কাজে তদারকি মুল্যায়ন ও সিডিউল দেখে সরকারি টাকা ছাড় দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। এছাড়া যে অর্থে ও লক্ষে এই প্রকল্প তা বাস্তবায়নেরও জোর দাবি জানান।
এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম গ্রামের কাগজকে জানিয়েছেন, প্রকল্পে সিডিউল অনুযায়ীই ভৈরব খনন কাজ ৮০ শতাংশ শেষ হয়েছে। ৯৬ কিলোমিটারের মধ্যে ৬০ কিলোমিটারে ৮০ শতাংশ এবং ৩৬ কিলোমিটার ৫০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। পাড় বাধাসহ অন্য কাজ অগ্রগতি হয়েছে ৬৯ শতাংশ। গড় হিসেবে সব কাজের ৮০ শতাংশ শেষ হয়েছে। সিডিউল অনযায়ীই মাপজোকে করে কাজ বুঝে নেয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ড্রেজার মেশিন ব্যবহার হলেও সিডিউলের ব্যত্যয় ঘটেনি। তবে শহরের অংশে ৪ কিলোমিটারের কাজ এখন দৃশ্যমান হয়নি সত্য। কিছু স্থাপনা এখনও বাধা হয়ে আছে। পাড়ে মাটি রাখার জায়গা নিয়ে একটু সমস্যা হবে। তবে চলতি মাসেই চূড়ান্তভাবে শহরের অংশ খনন কাজ শুরু হবে। এই কাজটি সম্পন্ন হলে গোটা ৯৬ কিলোমিটারের খননই দৃশ্যমান হবে।
সুত্রঃ গ্রামের কাগজ
No comments:
Post a Comment