প্রভাতে শিশির ভেজা ঘাস আর ঘন কুয়াশার চাঁদর, শীতের আগমনের বার্তা জানান দিচ্ছে। মৌসুমী খেজুরের রস দিয়েই গ্রামীণ জনপদে শুরু হয় শীতের আমেজ। শীত যত বাড়বে খেজুর রসের মিষ্টিও তত বাড়বে। শীতের দিনের সবচেয়ে আকর্ষন দিনের শুরুতে খেজুরের রস, সন্ধ্যা রস ও সুস্বাদু গুড়-পাটালি। আর সুস্বাদু পিঠা, পায়েস তৈরীতে আবহমান কাল থেকে খেজুর গুড় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দেশের প্রাচীন জনপদ যশোর জেলা খেজুর গুড়-পাটালির জন্য বিখ্যাত। যে কারণেই প্রবাদ আছে ‘যশোরের যশ খেজুরের রস’।
দেশ ছাড়িয়ে এখন দেশের বাইরেও খেজুরের গুড়-পাটালির ব্যাপক চাহিদা। এই অঞ্চলের খাজুরা খেজুর গুড়-পাটালি তৈরির মূল কেন্দ্রবিন্দু। খেজুরের গুড়-পাটালি তৈরির জন্য এই অঞ্চলের গাছিরা যেমন দানা পাটালি তৈরি করতে পারে এমন পাটালি তৈরির কারিগর দেশের আর কোথাও নেই বললেই চলে।
যে কারণে শীত মৌসুম শুরুতে যশোর-মাগুরা মহাসড়কের খাজুরা বাজার বাসস্টান্ডে রাস্তার দুই পাশে তাকালেই চোখে পড়ে বিলাশ বহুল সব মাইক্রো বাস এবং ভিআইপি যাত্রীদের। যাদের সাথে আলাপ করলেই বোঝা যাবে এরা গুড়-পাটালি খুজছে। এসব লোকের চাহিদা মিটাতে গািছরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাই মৌসুম শুরু না হতেই খেজুর গাছ কাটতে শুরু করেছে তারা।
অল্প দিনের মধ্যেই তারা ধারালো দা (গাছিদা) দিয়ে খেজুর গাছের সোনালি অংশ বের করবে। যাকে বলে চাঁচ দেওয়া। তার সপ্তাহ খানেক পর নোলনের স্থাপন এবং তারপর শুরু হবে সুস্বাদু খেজুর রস সংগ্রহের কাজ। সব মিলিয়ে চলতি মাসেই গৌরব আর ঐহিহ্যের প্রতিক মধু বৃক্ষ থেকে সু-মধুর রস বের হবে।
গ্রামের ঘরে ঘরে শুরু হবে গুড় পাটালি তৈরির উৎসব। বাড়ীতে বাড়ীতে খেজুুরের রস জালিয়ে পিঠা, পায়েসসহ নাম না জানা হরেক রকমের মুখরোচক খাবার তৈরির ধুম পড়বে। যশোর সদর উপজেলার তেজরোল, গহেরপুর, কোদালিয়া, লেবুতলা, খাজুরা, এনায়েতপুর, আগ্রাইল, আন্দোলপোতা, দলেননগরসহ প্রায় ২৫টি গ্রামে ও বাঘারপাড়া উপজেলার কঠুরাকান্দি, মির্জাপুর, মথুরাপুর, দাঁদপুর, ধর্মগাতী, পার্বতীপুর, চন্ডিপুরসহ প্রায় ১৫টি গ্রামে গুড়-পাটালি তৈরি হয়। এর মধ্যে খাজুরার বাওনডাঙ্গা গ্রামে অভিনব কৌশলে তৈরি হয় সেই মোটা দানার সুস্বাসু সেই ঐতিহ্যবাহী বাওনডাঙ্গার পাটালি। এই সকল এলাকায় চাষীরা ইতিমধ্যে রস সংগ্রহের জন্য তাদের প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে।
পাটালি উৎপাদনকারী কৃষক তেজরোল গ্রামের নাজিম উদ্দীন বলেন, খেজুরের গাছ এখন আগের মত বেশী নেই। ১ কেজি দানা পাটালি তৈরি করতে কমপক্ষে ২শত টাকার বেশী খরচ হয়। কিন্তু ভালো জিনিসের দাম দিতে চাই না ক্রেতারা। তাছাড়া কিছু অসাধু লোক অল্প গুড় উৎপাদন করে তাতে চিনি মিশিয়ে পাটালি তৈরি করে অল্প দামে বিক্রি করে থাকে। যে কারনে ভালো জিনিসের কদর থাকেনা।
গুড় ব্যবসায়ী গহেরপুর গ্রামের ইমারত মোল্যা বলেন, অসাধু কিছু ব্যবসায়ী রাজশাহী এবং কুষ্টিয়া থেকে আখের মুচি ও খেজুরের মুচি এনে তাতে চিনি মিশিয়ে বাজারজাত করে। সরকারের খাদ্য দ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য বিভাগ বা সংশ্লিষ্ট যদি ভেজাল বিরোধী অভিযান পরিচালনা করে কঠোর আইন প্রয়োগ করে তাহলে ভেজাল গুড় বিক্রি বন্ধ হবে।
এদিকে ইট-ভাটার আগ্রাসনের কারণে আগের তুলনায় আগের তুলনায় খেজুর গাছের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। জ্বালানি হিসাবে ইট-ভাটায় খেজুর গাছ পোড়ানে আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। তারপরও ভাটার মালিকেরা টাকার বিনিময়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাদের হাত করে অবাধে ধ্বংস করে চলেছে খেজুর গাছ।
ফলে যশোর অঞ্চলে আগের তুলনায় বর্তমানে খেজুর গাছের সংখ্যা হ্রাস পেতে শুরু করেছে। এক্ষেত্রে বন বিভাগ কোন কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে খেজুর গাছ শুধু আরব্য উপন্যাসের গল্পে পরিণত হবে।
No comments:
Post a Comment