‘এসআই শামীম আমারে এগুলো শিখাই দিছিলো ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে বলার জন্য। আর বলছে, আমি যদি ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সব স্বীকার না করি তাহলে আমারে আবার রিমান্ডে নিবো, ক্রসফায়ার দিয়া দিব’
“আমি যদি সেদিন ওই মাইয়াকে ধর্ষণের পর হত্যার জবানবন্দি না দিতাম, আজকে আমি লাশ থাকতাম। যে পর্যন্ত স্বীকার না করতাম, সেই পর্যন্ত উল্টা লটকাইয়া হাত-পা একলগে বাইন্ধা কুত্তার মত পিটাইতো। আর বলতো, স্বীকার না করলে ক্রসফায়ার আর রিমান্ডে দিবো। স্বীকার করছিলাম দেইখাই আজকে বাঁইচা আসছি। তা না হলে আমার স্ত্রী-সন্তানরা আমার লাশের অপেক্ষায় থাকতো।”
চোখের পানি মুছতে মুছতে এভাবেই গ্রেফতার ও পরবর্তী সময়ে তার সাথে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ নির্যাতনের বর্ণনা দিচ্ছিলেন নারায়ণগঞ্জে আলোচিত স্কুলছাত্রী “ধর্ষণ ও হত্যার দায়” স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেওয়া নৌকার মাঝি খলিলুর রহমান।
বুধবার (২ সেপ্টেম্বর) দুপুরে আদালত তার জামিন মঞ্জুর করলে নারায়ণগঞ্জ বন্দর উপজেলার একরামপুর এলাকায় ভাড়া বাসায় ফেরেন খলিলুর রহমান। তবে পুলিশের নির্যাতনের কারণে গুরুতর অসুস্থ থাকায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় তাকে। বৃহস্পতিবার আবারও বাসায় ফিরে বাসায় ফিরে আসেন খলিলুর রহমান।
সেখানেই কথা হয় খলিলুর রহমানের সাথে। তিনি বলেন, “আমার টিবি রোগ আছে। ফুসফুসে পানি জমার সমস্যাও অনেক দিনের। মেডিকেল থাইকা ডাক্তাররা বলছে কয়েকটা পরীক্ষা করাইতে। এগুলা অনেক টাকার ব্যাপার। এহন এত টাকা পামু কই। এমনিতেই আমারে জামিন করাইতে আর সংসার চালাইতে এ কয়দিন বউয়ের বহুত দেনা করতে হইছে। এহন দেনা দিমু না চিকিৎসা করামু।”
আবেগাপ্লুত খলিলুর রহমান বলেন, “জীবনেও কল্পনা করি নাই আমার লগে এমন হইবো। ৮ থেকে ১০ বছর ধইরা ৫ নম্বর ঘাটে নৌকা চালাই। এ দিয়াই স্ত্রী-সন্তান নিয়া চলি। কেউ আমার সম্পর্কে খারাপ কোনো কিছু বলতে পারবো না।”
কী ঘটেছিল গ্রেফতারের দিন
খলিলুর রহমান বলেন, “ওই দিন শুক্রবার বিকেলে এসআই শামীমসহ দুই তিনজন পুলিশ আসলো। আসার পর আমরা ছয়জন যারা ছৈইয়া নৌকা চালাই, তাদের ডাইকা বলল থানায় যেতে। কিছু জিজ্ঞাসাবাদ কইরা ছেড়ে দিবো। ছয়জনের মধ্যে আমিও ছিলাম। সবার সাথে আমিও গেলাম। কপালটা এতই খারাপ যে আমারেই প্রথম ঢুকাইলো। আর আব্দুল্লাহ্ আমার গালের দুইটা দাগ দেখাইয়া কইলো, ওরা নাকি আমার নৌকা দিয়া ঘুরছে। পরে আমি ও আব্দুল্লাহ্ মিললা ওই মাইয়ারে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ কইরা মাইরা নদীত ফালাইয়া দিছি।”
“পুলিশরা আমারে লকআপে ঢুকায় দিয়ে বাকি ৫ জনরে ছাইড়া দিলো। ওই দিন রাত ২টার দিকে এসআই শামীম ও আরও তিনজন পুলিশের পোশাক পড়া তাদের নাম জানি না, তারা আমার হাত-পা বানলো। তারপর চিৎ কইরা নাকে মুখে ইচ্ছামত ঠাণ্ডা পানি ঢাললো। দম বন্ধ হইয়া আসতাছিলো, ভাবছিলাম মইরাই যামু। পরে উপরে লটকাইয়া হাত-পায়ে কুত্তার মত অনেকক্ষণ পিটাইলো।”
“প্রথমে আমি স্বীকার যাই নাই। পরে এসআই শামীম আইসা কইলো, ‘স্বীকার না করলে এ ধরনের আসামিদের আমরা ক্রসফায়ার দিয়া দেই’। পরে আমি বাধ্য হইয়া স্বীকার করি।”
খলিলুর রহমান আরও বলেন, “এরপরে রবিবার আদালতে নিলে রিমান্ডে কম মাইর দেওয়ার কথা বইলা এসআই শামীম আমাকে বলে বাড়িতে ফোন দিয়া টাকা ২০ হাজার টাকা আনাইতে। আমার বউ টাকা দিছিলো। কিন্তু মাইর তারা কমায় নাই।”
আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমি নৌকা চালাই, মূর্খ মানুষ। ১৬৪ ধারা জবানবন্দি দিলে কি হয় কিছুই জানতাম না। আদালতে জবানবন্দি দেয়ার আগে এসআই শামীম আমারে এগুলো শিখাই দিছিলো ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে বলার জন্য। আর বলছে, আমি যদি ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সব স্বীকার না করি তাহলে আমারে আবার রিমান্ডে নিবো, ক্রসফায়ার দিয়া দিব। আমি যদি জানতাম আদালতে কাছে সব খুইলা বললে আমি বাঁইচা যামু। তাহলে হলে আমি জীবনেও স্বীকার যাইতাম না।”
খলিল মাঝি বলেন, “জিসা মনি, আব্দুল্লাহরে আমি জীবনেও দেখি নাই। ওরা আমার নৌকায়ও কখনও উঠে নাই। আমি আব্দুল্লাহরে জিজ্ঞাসও করিছলাম যে, ‘তুই আমারে চিনস?’। ওই বলছে ‘না’। আব্দুল্লাহ্ও আমারে কোনো দিন দেখেও নাই। জেলে যাওয়ার পর আব্দুল্লাহর সাথে আমার সাথে এ ব্যাপারে কথা হইছিলো। আব্দুল্লাহ্ বার বার বলতাছিলো যে, আমাদের থানায় নেওয়ার আগেই ওরে শিখাইয়া দেওয়া হইছিলো যে যার গালে গোটার দাগ আছে এবং যারে প্রথমে নিয়া আসবো তারেই দেখায় দেওয়ার জন্য। তাই ও আমাকে দেখায় দেয়।”
“আব্দুল্লাহ্ বলছে যদি আব্দুল্লাহ্ আমাকে না দেখাইতো তাহলে ওরে আরও মারধর করতো। তাই নিজেকে বাঁচাইতে ওয় (আব্দুল্লাহ্) আমাকে দেখাই দিছিলো সেদিন।”
এদিকে, মাঝি খলিলুর রহমানের স্ত্রী শারমিন বেগম বলেন, “গ্রেফতারের মাত্র একমাস আগে কিস্তি তুইলা চিকিৎসা করাইয়া সুস্থ করছি ওনারে। কিন্তু পুলিশের দেওয়া মিথ্যা মামলায় মারধরে এখন সে বিছনায়। জেলের থেকে বের হইয়া বাসায় না নিয়া আসতে আসতেই সে অজ্ঞান হইয়া যায়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়। ডাক্তাররা বিভিন্ন পরীক্ষা দিয়ে দিছে। এগুলা করালে তারা বুঝবো যে কি হইছে। কিন্তু অনেক টাকা দরকার। তাই পরীক্ষা না করাই ফেরত নিয়ে আসছি।”
শারমিন বলেন, “আমার ছোট ছোট তিনটা মেয়ে তারওপর বড় জন প্রতিবন্ধী। সামনে কেমনে চলমু, সংসার কেমনে চালাবো কিছু ভাবতে পারতাছি না। কিন্তু আমার স্বামীরে যারা মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করছে আমি তাগো শাস্তি চাই।”
তবে এসব অভিযোগকে ভিত্তিহীন দাবি করে চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত মামলার সাবেক তদন্ত কর্মকতা এসআই শামীম আল বলেন, “তারা চাইলেই ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সত্যি কথা বলতে পারতো। কিন্তু তারা তা বলে নাই। এখন তারা বলছে যে তাদের কাছ থেকে জোরপূর্বক জবানবন্দি নেওয়া হইছে এবং আমরা তাদের ভয় দেখাইয়া বাধ্য করছি।” তাদের অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন জানিয়ে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন এসআই শামীম।
খলিল মাঝির অভিযোগ প্রসঙ্গে সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসাদুজ্জামান বলেন, “আমার এ বিষয়ে কিছু বলার নেই। এখন এটা তদন্তের বিষয়।”
উল্লেখ্য, গত ৪ জুলাই নারায়ণগঞ্জে শহরে পঞ্চম শ্রেণির এক স্কুলছাত্রীকে গণধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করে লাশ গুমের উদ্দেশ্যে শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার অভিযোগে চলতি মাসের শুরুর দিকে তিন আসামিকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
গ্রেফতারকৃতরা হলেন- কথিত প্রেমিক আব্দুল্লাহ্, ইজিবাইক চালক রাকিব ও নৌকার মাঝি খলিল। পরে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সদর মডেল থানার এসআই শামীম আল মামুন তিনজনকে রিমান্ডে নিলে গত ৯ আগস্ট জেলা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মিল্টন হোসেন ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ হুমায়ুন কবিরের পৃথক আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয় আসামিরা। স্বীকারোক্তিতে তারা জানায়, পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রীকে গণধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে শীতলক্ষ্যা নদীতে লাশ ভাসিয়ে দিয়েছে।
এদিকে, নিখোঁজের ৫১ দিন পর ২৩ আগস্ট মোবাইল ফোনে টাকা চেয়ে মায়ের কাছে ফোন করে ওই কিশোরী। খবর পেয়ে বন্দর উপজেলার নবীগঞ্জ এলাকা থেকে স্বামীসহ ওই স্কুলছাত্রীকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।
এ ঘটনায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই শামীমকে প্রত্যাহার এবং ও আসামির পরিবারের কাছ থেকে অর্থ আদায় ও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার বিষয়ে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরে প্রাথমিক তদন্তে তদন্ত কর্মকর্তা এসআই শামীমের অসততা প্রমাণিত হওয়ায় তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে বিভাগীয়ভাবে মামলা দায়েরর সুপারিশ করা হয়।
এই মামলার আরও দুই আসামি আব্দুল্লাহ ও রাকিব এবং ওই স্কুলছাত্রীর স্বামী ইকবাল পন্ডিত কারগারে আছেন।
No comments:
Post a Comment