যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর। দরুদ ও সালাম আল্লাহর রাসূল (সা) এর উপর। পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
প্রশ্নটা এখন ব্যাকডেটেড হয়ে গেছে এখনকার প্রজন্ম প্রশ্ন করে ‘আমরা কি প্রেম করতে পারবো?’ সে যাই হোক। আবার অপরদিকে অনেকের ধারণা কোন ভালবাসা-বাসির মধ্যে যাওয়া যাবে না বরং ‘পারিবারিক পছন্দে’ বিয়ে করতে হবে। কারণ এটাই একমাত্র ইসলামসম্মত পন্থা।’ কিন্তু বিয়ের পূর্বে কাউকে পছন্দ করা যাবেনা এটা ঠিক নয়। আমাদের ভেতরে এ ভুল ধারণা কাজ করছে কারণ আমরা প্রেম (Relationship) ও ভালোবাসাকে একই পাল্লায় মাপছি।
বর্তমানে এমন হয় যে, ছেলে পড়াশোনা শেষ করে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একটা চাকরি যোগাড় করার পর বাবা-মার খেয়ালে আসে যে ছেলের বিয়ে দেয়া দরকার। শুরু হয় পাত্রী খোঁজা অভিযান। পাত্রী পাবার পর ছেলেকে পিতা-মাতা জিজ্ঞাসা করেন, এরকম একটা মেয়ে পেয়েছি, তোমার কি মত? লাজুক ছেলে সলজ্জে উত্তর দেয়, ‘আপনারা মুরুব্বী মানুষ, আপনারা যা ভালো বুঝেন তাই করেন।’ মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলে মেয়ে উপহার দেয় আবহমান উত্তর, ‘আমার আর কি বলার আছে; আপনাদের মতই আমার মত।’ অবশেষে সকল খালা-ফুফুকে সন্তুষ্ট করে তাদের বিয়ে হয়। তবে যাদের বিয়ে তাদের পছন্দের চেয়ে দুই পরিবারের পারস্পরিক পছন্দই বিয়েতে প্রাধান্য পায় বেশী।
এটা যে ইসলামসম্মত নয় বা এটা ঠিক নয়, তবে এটাই সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি কি? আল্লাহ সুবনাহানাহু ওয়া তায়া’লা কুরআনে বলেছেন-
• মেয়েদের মধ্যে থেকে যাদের ভাল লাগে তাদের বিয়ে করে নাও দুই, তিন, কিংবা চারটি পর্যন্ত। আর যদি এরূপ আশঙ্কা কর যে, তাদের মধ্যে ন্যায় সঙ্গত আচরণ বজায় রাখতে পারবে না, তবে, একটিই। [সূরা নিসা :৩]
লক্ষ্য করুন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়া’লা আমাদের সেইসব নারীদেরকে বিয়ে করতে বলছেন যাদেরকে আমাদের ভাললাগে। মারীফুল কুরআনে বলা হয়েছে, ‘যাদের তোমরা পছন্দ করো’ আর হাফেজ মুনির ভাই অনুবাদ করেছেন, ‘যাদেরকে তোমরা ভালোবাসো’। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়া’লা আমাদের পছন্দকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
# আনাস (রাঃ) এ ধরণের একটা ঘটনা বর্ণনা করেছিলেন , একবার এক মহিলা রাসূলুল্লাহর (সা) খেদমতে হাজির হয়ে তার সাথে নিজেকে বিয়ের জন্য সরাসরি প্রস্তাব পেশ করেন। এ কথা শুনে পাশে থাকা আনাস (রাঃ) এর কন্যা বলে উঠলেন,‘মেয়েটা কত নির্লজ্জই না ছিল’ আনাস (রাঃ) তাকে বললেন, ‘সে তোমার তুলনায় অনেক ভালো ছিল। সে রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল এবং নিজেকে রাসূলের (সা.) নিকট বিয়ের জন্য পেশ করেছিলো।’ [ সাহল ইবন সাদ(রাঃ) থেকে অন্য বর্ণনায় এ ঘটনাটি সাহীহ বুখারীতে এসেছে। ৮ম খন্ড, ৬০০৭ ও ৬০৩৬ নং হাদিস। ]
এর জন্য রাসূল (সা) তাকেকে কোনরকম তিরস্কার করেননি; তিনি নীরব থাকেন। পরবর্তীতে এক সাহাবী তাকে বিয়ের জন্য আগ্রহী হলে রাসূল (সা)তাদের বিয়ে দিয়ে দেন।
# আবার খানসা বিনতে খিদাম (রাঃ)র স্বামী উহুদ যুদ্ধে শাহাদাৎ বরণ করলে তার বাবা তাকে এক ব্যাক্তির নিকট বিয়ে দিয়ে দেন। তখন হযরত খানসা (রা.) রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কাছে এসে বললেন, ‘আমার পিতা আমাকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন; অথচ আমি আমার সন্তানের চাচাকেই অধিক পছন্দ করি’। [সাহীহ বুখারী,৮ম খন্ড, ৬০৫৪ ও ৬০৫৩]
তার কথাগুলো লক্ষ্য করুন। তার বিয়ে হয়ে যাবার পর তিনি রাসূলের(সা) কাছে এসে জানান, তার স্বামী হিসেবে তার সন্তানের চাচাকেই তিনি বেশী পছন্দ করবেন। এরপর আল্লাহর রাসূল (সা.) তার বিয়ে ভেঙ্গে দিলেন।
এ ধরণের আরেকটি ঘটনা পাওয়া যায় মুগীরা ইবন শুবার (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ক্ষেত্রে।[৩] উসমান ইবন মাযউনের (রা)মৃত্যুর পর তার কন্যাকে তার চাচা কুদামাহ বিয়ে দিয়ে দেন ইবন উমারের(রা)সাথে। কিন্তু ইবন উমার (রা.)প্রথম সারির একজন সাহাবী হওয়া সত্ত্বেও মেয়েটি এ বিয়েতে রাজি ছিলনা কারণ সে মুগীরা ইবন শুবাকে (রা.) পছন্দ করতো এবং সে চেয়েছিল যেন মুগীরা ইবন শুবা রাদিয়াল্লাহু আনহু)তাকে বিয়ে করেন। অবশেষে তার চাচা এ বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে মুগীরার (রা.)সাথে তার বিয়ে দেন। [ইবনে মাজা,২য় খন্ড,১৮৭৮ নং হাদিস]
এমন আরও অনেক অনেক ঘটনা সহীহ হাদীসে রয়েছে। বিয়ের পূর্বে আপনি কাউকে ভালোবাসতে পারবেন না, পছন্দ করতে পারবেন না এমন কোন নির্দেশ পাওয়া যায় না। এমনকি আপনি অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ করলেও রাসূলের(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)পরামর্শ হলো,
# “তুমি আগে গিয়ে তাকে দেখে নাও কেননা এটি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও সম্প্রীতিতে সহায়ক হবে।” [ইবনে মাজা,২য় খন্ড, ১৮৬৫ নং হাদিস]
আপনি বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হবেন এটাই স্বাভাবিক, কেননা এটা আপনার ফিতরাত। সূরা আর-রূমে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়া’লা বলছেন,
• আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে হচ্ছে যে তিনি তোমাদের মধ্যে থেকে তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন যুগলদের, যেন তোমরা তাদের মধ্যে স্বস্তি পেতে পার, আর তিনি তোমাদের মধ্যে প্রেম ও করুণা সৃষ্টি করেছেন। (সূরা রুম:২১)
কোন মুসলিম ভাই/বোনকে দ্বীনদারী, চরিত্র আপনার ভালো লাগতেই পারে। তবে এ ভালোবাসার একটা সীমারেখা রয়েছে। যদি তাকে পেতে চান, তাহলে চিরদিনের জন্য তাকে আপন করে নিন; দুই মাস বা দুই বছরের জন্য নয়। কাউকে পছন্দ করলে ইসলামের মূলনীতিটা হল,
# ‘তোমরা যখন বিয়ের জন্য এমন ছেলে বা মেয়ে পেয়ে যাবে যার দীনদারী চরিত্র ও জ্ঞান-বুদ্ধিকে তোমরা পছন্দ করবে, তো তখনই তার সাথে বিয়ের সম্বন্ধ স্থাপন করো।’ (তিরমিযী)
আবার অভিভাবকদেরকে বলা হয়েছে,
# “যদি এমন কেউ তোমার কাছে আসে (বিয়ের পয়গাম নিয়ে)– যার চরিত্র এবং তাকওয়া সন্তোষজনক, তাহলে তার কাছে (তোমার মেয়েকে) বিয়ে দাও। যদি এমনটি না কর, তাহলে পৃথিবীতে মারাত্মকরকম ফেতনা ও বিপর্যয় দেখা দিবে।” [তিরমিযি]
এটাই অবৈধ সম্পর্কের সাথে এর মাঝে পর্দা টেনে দিয়েছে। আপনি কাউকে পছন্দ করতে পারবেন কিন্তু তার সাথে কোনরূপ সম্পর্কে জড়াতে পারবেন না। বিয়ের প্রস্তাব সংক্রান্ত হাদিসগুলো পর্যালোচনা করলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে। আপনি কাউকে পছন্দ করলেই তাকে গিয়ে জানাতে পারবেননা , ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’। আপনাকে তার অভিভাবক সাথে যোগাযোগ করতে হবে এবং বিয়ের প্রস্তাব দিতে হবে।'
আল্লাহ বলেন,
• আর বিয়ে দিয়ে দাও তোমাদের মধ্যের অবিবাহিতদের (সূরা নুর:৩২)
আর যদি বিয়ে করতে কোন সমস্যা থাকে তাহলে আল্লাহ বলছেন-
• যারা বিবাহে সামর্থ নয়, তারা যেন সংযম অবলম্বন করে যে পর্যন্ত না আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেন।(সূরা নুর:৩৩)
তবে সামর্থ্য বলতে ত্রিশ হাজার টাকার চাকরি, আর ফ্ল্যাট না থাকার কথা বলা হয়নি কারণ সেই সূরাতেই রব্বুল আলামীন বলেন-
• তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।(সূরা নুর:৩২)
এতে বিয়ের পূর্বে কোন প্রকার প্রেম বা রিলেশনের সুযোগ নেই। আর আমরা যারা অবিবাহিত আছি তাদের সবার উচিত আল্লাহর বলে দেয়া পন্থায় সিজদায় তারই নিকট পৃথিবীর সর্বোত্তম সম্পদের তাউফিক চাওয়া-
رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا
• হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের স্ত্রীদের পক্ষ থেকে এবং আমাদের সন্তানের পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে চোখের শীতলতা দান কর এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্যে আদর্শস্বরূপ কর। (২৫:৭৪)
No comments:
Post a Comment